Wednesday, July 6, 2016

মিশন পাইন্দু সাইতার প্লাস সিপ্পি আরসুয়াং
সম্প্রতি ২৮.০৪.২০১৬ - ০২.০৫.২০১৬ তে মুসাফির গ্রুপের ইভেন্ট "মিশন পাইন্দু সাইতার প্লাস সিপ্পি আরসুয়াং" সম্পন্ন করে আসলাম। সাথে ছিল ১৪ জনের বিশাল এক মুসাফির বাহিনী। তারই আলোকে এ ডক ফাইলটি লেখা। মূলত গল্প বলার আদলে এ ফাইলটি লিখছি। সহজ করে আর আমরা যেভাবে গিয়েছিলাম সেভাবে যাতে খুব সহজেই সবাই বুঝতে পারে আর আমিও বুঝাতে পারি।
সিপ্পি পাহাড় সবাই চেনেন, বাট সিপ্পির আরেক নাম যে বম ভাষায় রাম জং এটা খুব কম লোকেই জানে। উচ্চতা ২৯৩৯ ফুট। আর পাইন্দু সাইতার হচ্ছে হালের সবচেয়ে আলোচিত ওয়াটারফলস। খুব কম মানুষের পা পড়েছে এখানে। ইউরোপ আমেরিকার মত সুন্দর গঠনের (মিলের দিক দিয়েও) ওয়াটারফলস বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এই একটাই। আমরা নাফাখুম, আআমিয়াখুম, চ্যাদল্যাংকে জলপ্রপাত বলে থাকি, বাট জলপ্রপাত এর ডেফিনিশন অনুযায়ী এটাই বাংলাদেশের একমাত্র জলপ্রপাত।
শুকনা মৌসুম আর বৃষ্টি না থাকায় পানি পেয়েছি খুবই কম। তবুও যেটুকু পেয়েছি আবহাওয়া বিবেচনায় তাই এনাফ। পানি কম থাকলো, এ অবাক করা সৌন্দর্য দেখে আসাটাও ভাগ্যের ব্যাপার। তবে পানি কম থাকায় সরাসরি ফলসের নিচে পৌঁছে পাথরের বোল্ডারে দাঁড়িয়ে ঝর্ণার পানি গাঁয়ে মাখতে পেরেছি। নাচানাচি, জলকেলি খেলতে পেরেছি, ভরা বর্ষায় যা সম্ভব না।
০ দিনঃ কল্যাণপুর, সায়েদাবাদ, ফকিরাপুল থেকে শ্যামলী, হানিফ, এস আলম, ইউনিক বিভিন্ন বাসসমূহ রাত ৭ টা, ৮ টা, ৯ টা বিভিন্ন সময়ে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। আমরা হানিফের টিকেট কেটেছিলাম। রাত ৮ টায় কল্যাণপুর থেকে মিনিবাসে সায়েদাবাদ। সায়েদাবাদ থেকে রাত ৯.৩০ এ মেইন বাসের যাত্রাশুরু। বান্দরবান পৌঁছায় পরদিন ভোর ৫.৩০ এ।
১ম দিনঃ বাস যেখানে থামাবে সেখানেই হোটেল হিলভিউ, নেমে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তা। ১০ টাকা টমটম বাড়ায় চলে যান রোয়াংছড়ি যাওয়ার বাস স্ট্যান্ডে। সকাল ৮ টায় কোস্টার ছাড়ে ফার্স্ট ট্রিপ। প্রতি দেড় ঘন্টা পরপর। ফার্স্ট ট্রিপে চলে যান রোয়াংছড়ি জনপ্রতি ৬০ টাকা ভাড়ায়। সময় লাগবে ১ ঘন্টা ২০ মিনিট। আপনি চাইলে হোটেল হিলভিউ এর সামনে থেকে ডাইরেক্ট রোয়াংছড়ি মহেন্দ্র রিজার্ভ নিতে পারবেন। ১২০০ টাকা চাইবে, মুলামুলি করে ১০০০ এ যাইতে পারবেন। সময় লাগবে ৫০ মিনিট। ১৪ জন যাওয়া যায়, দুইপাশে ৬ এ ৬ এ ১২ জন, আর ড্রাইভারের সাথে সামনে ২ জন।
রোয়াংছড়ি নেমে এখান থেকেই যে কয়দিন থাকবেন পাহাড়ে সে কয়দিনের জন্য মশলা, মরিচ, পেয়াজ, ডাল, তেল, নুডলস, বিস্কিট, স্যালাইন, কাঁচা বাজার, সবজি, চা পাতি, মুরগি যা যা লাগে সব কিনে নেন। পাহাড়িরা কিন্তু মশলা খায়না। আর চাল পাহাড়িদের কাছেই কিনতে পারবেন। ট্রেকিং উপযোগী ফিতাওয়ালা ভাল গ্রিপের স্যান্ডেল কিনে নিয়ে যান এখান থেকেই। এখানে রাধামন হোটেল আছে। গাইড যখন বাজার করবে সে সময়টাতে চাইলে এই রাধামন হোটেলের তিন চারটা কক্ষ রিজার্ভ নিতে পারেন ঘন্টা দুই রেস্ট নেওয়ার জন্য। প্রতি রুমের জন্য ১৫০-২০০ টাকা দিলেই হবে।
খুব এডভেঞ্চারাস হলে রোয়াংছড়ি থেকে রনিপাড়া হেঁটে যেতে পারেন। সময় লাগবে পাহাড়িদের জন্য ৫ ঘন্টা, বাঙ্গালীদের জন্য ৬-৭ ঘন্টা। সকাল ১০ টার ভেতর রওনা দিলেও ৪.০০-৪.৩০ এর মধ্যে রনিপাড়া পৌঁছে যেতে পারবেন। তবে ১ম দিনের জন্য অনেক লোড হয়ে যায় যেহেতু আগের রাতে সারারাত বাস জার্নি করেছেন। তাই আমার সাজেশান রোয়াংছড়ি থেকে চান্দের গাড়ি রিজার্ভ নেন, ৫৫০০ টাকা। সময় লাগবে ২.০০-২.৩০ ঘন্টা। রনিপাড়া থেকে কিছুটা আগে এক খাড়া পাহাড়ের গোড়ায় নামিয়ে দেবে। এই পাহাড় ডিঙ্গাতেই শরীরের সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে। এখান থেকে ট্রেকিং করে রনিপাড়া যেতে ১ ঘন্টা লাগবে।
পাড়ায় গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে রেস্ট নেন। সন্ধ্যায় রনিপাড়া আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে রিপোর্ট করুন। আমাদের অনেক কাহিনী করেছিল, ট্যুরিস্ট লিস্ট, অনুমতিপত্র, আগের ক্যাম্পে জানাইছি কিনা ইত্যাদি। পাইন্দু, সিপ্পি যাইতে দেবে না এমন অবস্থা। লাস্টে ১০ মিনিট একনাগাড়ে বক্তৃতা দেওয়ার পর বেচারা শান্ত হয়েছিল, তারপর আমাদের সবার নাম ঠিকানা নেয় এবং বি গ্রেডে মেসেজ পাঠায়, সেখান থেকে অনুমতি আসার পর আমরা রেহাই পাই। এখানে খুবই উল্লেখযোগ্য বিষয় হল যে রনিপাড়া থেকে কারবারি বা পাড়ার প্রতিনিধি আর গাইড অবশ্যই নিয়ে যাবেন। ওরা আপনাকে ডিফেন্ড করবে। রোয়াংছড়ি এলাকাটা এখনও পর্যটনের আওতায় না আসায় অনুমতি পাওয়াটায় ঝামেলা করে। রাতে ভালমত ঘুমান। কারণ পরদিন খুব পরিশ্রম অপেক্ষা করছে আপনার জন্য
রনিপাড়াকে অনেকেই রোনিনপাড়া বলেন, যা ভুল। হেডম্যান রনি বমের নামানুসারে পাড়ার নাম রনিপাড়া। রনিপাড়ায় বম আর তঞ্চঙ্গা এই দুই সম্প্রদায়ের লোক বাস করে। বমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।
২য় দিনঃ ভোর ৫ টায় ঘুম থেকে উঠে হালকা খেয়ে রওনা দেবেন। যত ভোরে রওনা দিতে পারবেন, তত কষ্ট কম হবে। সূর্য উঠে গেলে রোদে কষ্ট বেশি হবে। ব্যাগ ট্যাগ সব পাড়ায় রেখে যান। সাথে শুধু পানি নেন। এই রনি পাড়া হচ্ছে আপনার বেস ক্যাম্প। রনিপাড়া থেকে দেবাছড়া পাড়ায় যেতে ১ ঘন্টা ৩০ মিনিট লাগবে। দেবাছড়া পাড়া থেকে পাইন্দু খালের ঝিরিপথে যেতে লাগবে আড়াই ঘন্টার মত । সেখান থেকে ঝিরিপথ ধরে আধঘণ্টা হাঁটলেই পাইন্দু সাইতার। ঝিরিপথে নামার আগে এই ৮৫ ডিগ্রি খাড়া পাহাড় অতিক্রম করতে হয়। সত্যিকারের ডেথজোন। লাইফে প্রথম বারের মত ভয় পেয়ে গেছিলাম। এখনও আত্মা কাঁপছে। পায়ের নিচে ঝুরঝুরে ধুলা যা বর্ষার কাদার চেয়েও ভয়ঙ্কর। স্লিপ খায়। ছোট ছোট ঢেলার উপর পা পড়লে হড়কে যায়। একটু এদিক সেদিক হলেই সোজা খাদের নিচে। বাঁচার উপায় নাই। সত্যিকারের পুলসিরাত। হাত দিয়ে কিছু ধরাও যায়না, এমন উনুন গরম ধুলামাটি, হাতে ফোঁসকা পড়ে। অন্য লতাপাতা জাতীয় কিছু নাইও। কেমনে যে চরম বিভীষিকাময় মূহুর্ত পার করে ঝিরিপথে নেমেছিলাম তা এখনও অবাস্তব লাগে। রনিপাড়া থেকে পাইন্দু সাইতারে যেতে টোটাল সাড়ে চার ঘন্টার মত লাগে। ভোর ৫.৩০ এ রনিপাড়া থেকে রওনা দিয়েছিলাম, ১০.০০ টায় পৌঁছেছিলাম। যাওয়ার পথে পাইন্দু সাইতারের আরও দুটি স্টেপ দেখতে পাবেন। পাইন্দু সাইতার -৩ এর গঠন আর সৌন্দর্য আমার কাছে অস্থির লেগেছে। পাইন্দু সাইতারে আমাদের গাইড নুডলস রান্না করে। তাই লবণ মাখিয়ে খাওয়া হয়, ক্ষুধায় সময় তাই অমৃত।
ঝর্ণায় জলকেলি খেলে, নাচানাচি করে গোসল করে আবারও সেই ভয়ঙ্কর পুলসিরাত পার হয়ে দেবাছড়া পাড়ায় ফিরে আসি। কেউ আর ঐ পাহাড় বেয়ে উঠতে চাইছিলাম না। বাট উপায় নেই। ২য় কোন রাস্তা নেই। বাধ্য হয়ে সেই একই পাহাড় ডিঙ্গাতে হয়। দেবাছড়া পাড়ায় পাইন্দু আসার সময়ই রান্না বান্না করতে বলেছিলাম। ফিরে সেখানেই পাহাড়ি মুরগির তরকারি দিয়ে ভাত খেয়ে নিই। তারপর ঘন্টাখানেক রেস্ট নিয়ে রনিপাড়ায় ফিরে আসি। রাতে ঘুম।
৩য় দিনঃ ভোরে উঠে ৫ টায় আবারও সিপ্পির উদ্দেশ্যে যাত্রা। একই পথে আবারও দেবাছড়া পাড়ায়। দেবাছড়া পাড়া থেকে সিপ্পি যেতে ২ ঘন্টা ৩০ মিনিট লাগে। সিপ্পি যাওয়ার জন্য বেস ক্যাম্প দেবাছড়া পাড়ায় করা ভাল। তবে দেবাছড়া পাড়ায় রাত্রিযাপন আর খাবারের মান খারাপ, সেই সাথে পানির কষ্ট। অন্তত রনিপাড়া থেকে। সিপ্পির চূড়ায় এক সময় ব্রিটিশদের একটা ক্যাম্প ছিল, আজও তার ধংসাবশেষ আছে। পাহাড়িদের কাছে শোনা, সিপ্পির চূড়ায় নাকি একজোড়া বাঘ আছে, এখনও মাঝেমধ্যে বের হয়। সত্য মিথ্যা জানিনা। রনিপাড়া থেকে সিপ্পি যেতে ৪ ঘন্টা আসতে ৪ ঘন্টা লাগে। প্ল্যান ছিল, রাতে রনিপাড়া থেকে পরদিন সকালে হেঁটে রওনা দেব। তবে সময় পর্যাপ্ত থাকায় আর পরেরদিনের সময় সেভ করার জন্য বেলা ৫ টার মধ্যেই তল্পিতল্পা গুছিয়ে রওনা দেই। আর্মি ক্যাম্প থেকে রিপোর্ট করে আসতে ৫.৩০ বেজে যায়। সেই খাড়া পাহাড় ডিঙ্গিয়ে যখন চূড়ার মাথায় উঠি, তখন সন্ধ্যা ৬.৩০ মিনিট বেজে গেছে। পাহাড়ের বুকে ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসলো। রাতের অন্ধকারের হাঁটা শুরু করি। ঘন্টা তিনেক হেঁটে আমরা যখন পাইন ক্ষ্যং পাড়ায় পৌঁছাই তখন রাত ৯.৩০ বাজে। পাড়ায় এক ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। পাহাড়ি ঝিরির পানি পাইপ লাগিয়ে টেনে এনে সিমেন্ট দিয়ে বাধাই করে ট্যাবকলের মত বানানো হয়েছে। সেখানে গোসল করে ঘরে যেতেই শুরু হল কালবৈশাখী। সফরসঙ্গী পথিক বলে উঠলো তার নাকি ভিজতে ইচ্ছা হচ্ছে। নেমে গেলাম ঝড়ের মাঝে। ঘন্টাখানেক ভিজলাম। বারংবার বিদ্যুৎ চমকানোর মাঝে ঠাঠা পড়ার ভয় মাথায় নিয়ে পিচ্ছিল পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটার অনুভুতি আর যেভাবেই হোক ভাষায় ব্যাক্ত করার মত না। রাতে খাওয়া দাওয়া করে ঘুম।
৪র্থ দিনঃ শেষ দিন। ভোর ৬.৩০ টায় উঠে আবার হাঁটা শুরু। শুনলাম কাছেই একটা ঝর্ণা আছে। স্থানীয়রা চিনে বাট কোন ট্রাভেলার বা ট্যুরিস্ট এর নজরে আসেনি। পাইন ক্ষ্যং পাড়া থেকে এক বম বালক নিলাম। নাম পালক। ১ ঘন্টা ৩০ মিনিটের মত হেঁটে ঝর্ণায় পৌঁছালাম। দারুণ সুন্দর ঝর্ণা। ঝর্ণার কোন নাম নেই।
ঝর্ণার নিচে বিশাল একটি কুম আছে। ৮ম শ্রেণি পড়ুয়া বম বালক পালকের কাছে জানতে পারি কুমটির নাম "কিং লং ক্লাক নাক"। বম ভাষায় কিং লং মানে ধান রাখার ঢোল। ক্লাক নাক মানে পড়ে যাওয়া। একদিন এক ধান রাখার ঢোল এখানে পড়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে এই কুম এই নামেই পরিচিত। তাই ঝরণার নাম দিলাম "কিং লং ক্লাক নাক "। ঝর্ণা দেখে আবার হাঁটা শুরু। ৪ ঘন্টা হেঁটে রোয়াংছড়ি যখন আসি তখন বেলা ১ টা বাজে। খাওয়া দাওয়া করে আবার হোটেল রাধামনে ঘন্টা দুয়েক রেস্ট নিয়ে বান্দরবান চলে আসি। রাত ১০ টার টিকেট কাটা ছিল। শ্যামলীতে। বাসে ঢাকা ব্যাক।
রোয়াংছড়ি থেকে বান্দরবন সকাল ৮ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত প্রতি দেড় ঘন্টা পরপর কোস্টার ছাড়ে। লাস্ট ট্রিপ বিকাল ৫ টা। ভাড়া ৬০ টাকা। মিস করলে এছাড়াও মহেন্দ্র রিজার্ভ নিয়ে যেতে পারেন। লোকাল সিএনজিও চলে ভাড়া ৮০ টাকা।
যা যা লাগবেঃ
১. ফিতাওয়ালা ভাল গ্রিপের স্যান্ডেল। দাম ১২০ টাকা, গুলিস্তানের মার্কেটে পাওয়া যায়, রোয়াংছড়ি থেকেও কিনতে পারবেন।
২. জার্সি ও থ্রি কোয়ার্টার বা হাফপ্যান্ট। রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সিলোনা, লিভারপুল, চেলসি, বায়ার্ন, ম্যান ইউ, বা বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের। কাল রঙের হলে চলবে না। কাল কাপড়ে সূর্যের তাপ বেশি শোষিত হয়। পাওয়া যাবে যেকোন স্পোর্টস দোকানে। উত্তরায় আজিমপুরে আমির কমপ্লেক্সেও পাওয়া যাবে।
৩. পেন্সিল ব্যাটারিচালিত টর্চ লাইট কিনেন। কারেন্টে রিচার্জেবল না হলেই ভাল। কারণ পাহাড়ে কারেন্ট নাই।
৪. হেড ল্যাম্প সবথেকে বেস্ট, কারণ টর্চ হাতে ধরে থাকতে হয়। পাহাড় বেয়ে উঠার সময় দুইহাত ফ্রি রাখা প্রয়োজন। কপালে হেডল্যাম্প পড়লে দুইহাতই মুক্ত থাকে। দাম ৯০০ টাকা, পেন্সিল ব্যাটারির চাইতেও ছোট সাইজের ব্যাটারিতে চলে। ৬০০ টাকা দামের আছে, বাট ভাল না। ২০০০ টাকা দামেরটা বেস্ট।
৫. চাকু, ক্যাপ, সানগ্লাস।
৬. এংলেট অবশ্যই নিবেন। পায়ের হাতের পেশিতে টান লাগবে কম
৭. যেকোন ব্যাগ হলেই হয়, হালকা ভাল। ১০০০ টাকার ব্যাগই এনাফ। বেশি দাম দিয়ে কেনার দরকার নেই
৮. ব্যাগের জন্য রেইন কভার পাওয়া যায়, দাম ৩০০ টাকা, কভার পরাইয়া দিলেই বৃষ্টির হাত থেকে সুরক্ষা
৯. মশার জন্য অডোমস, রোদের জন্য সানস্ক্রিন ক্রিম, জোঁকের জন্য গুল, লবণ, খাওয়ার জন্য স্যালাইন
১০. অবশ্যই অবশ্যই ম্যালেরিয়ার ওষুধ খেতে হবে। অনেকেই ত্যাড়াব্যাড়া করে ওষুধ খান না। নিয়ম নিয়মই, পাহাড়ের নিয়ম আপনাকে মানতেই হবে। ম্যালেরিয়া প্রবণ জায়গা থেকে ঘুরে আসার এক বছর পরেও ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ হতে পারে। কাজেই সাবধান।
ডক্সিক্যাপ (ডক্সিসাইক্লিন ১০০ মি.গ্রা) প্রতিদিন একটি করে, প্রতিদিন একই সময়ে খাওয়া ভাল। ম্যালেরিয়া প্রবণ এলাকাতে রওনা হবার আগের দিন থেকে শুরু করে ফিরে আসার চার সপ্তাহ পর (২৮ দিন) পর্যন্ত প্রতিদিন একটা করে খেতে হবে। একদিনও মিস দেওয়া যাবে না। সুতরাং আপনি যদি সেখানে ৫ দিন থাকেন সেক্ষেত্রে যাওয়ার আগে ২ দিন + থাকবেন ৫ দিন + ফিরে আসার পর ২৮ দিন টোটাল ৩৫ টা ট্যাবলেট ৩৫ দিন খেতে হবে, একদিনও মিস দেওয়া যাবে না।
৩ থেকে ৮ নাম্বার পর্যন্ত সবগুলো জিনিসই পাবেন পিক সিক্সটি নাইন দোকান। আজিজ সুপার মার্কেট, থার্ড ফ্লোর। ভ্রমণের এমন কোন জিনিস নাই যে পাবেন না।
অবশ্যই পাওয়ার ব্যাংক লাগবে। জার্সি, থ্রি কোয়ার্টার একসেট পড়নে থাকবে, একসেট ব্যাগে থাকবে। টিশ্যু নিবেন। জার্সি টি শার্টের সুবিধা হচ্ছে ঘামলে বা বৃষ্টিতে অথবা ঝর্ণার পানিতে ভিজলে দ্রুত গায়ে থাকতে থাকতেই শুকিয়ে যায়।
কিছু পরামর্শঃ
১. যদি কোন কারণে রোয়াংছড়িতে থাকার প্রয়োজন হয়, রোয়াংছড়িতে থাকার হোটেল আছে দুইটা। হোটেল রাধামন, আর হোটেল রাম জং। রাধামনের ৫ টি নন এসি আর ৫ টি এসি রুম আছে। সগুলোই এটাচড বাথ আর টিভি আছে। এবং সবগুলোই সিঙ্গেল রুম। রুমভাড়া এসি-১৫০০ টাকা, নন এসি ৫০০ টাকা। রাম জং এও ১০ টির মত রুম আছে। প্রতি রুম এ ৩ টা বেড, ৫ জন থাকা যায়।
২. নরমালি থাকার জন্য প্রতিরাত জনপ্রতি ১৫০ টাকা করে আর রান্নার জন্য লাকড়ি বাবদ ৩০০-৪০০ টাকা করে দিলেই ওরা খুশি হয়। তবে পাহাড়ে পানির খুবই কষ্ট। এই শুকনা মৌসুমে তো আরও বেশি। অনেক দূর থেকে ঝিরির জমানো পানি আনতে হয়। সারারাত এক ফোঁটা দুই ফোঁটা করে পানি জমে। আমাদের যে বাড়িতে থাকার ব্যাবস্থা হয়েছিল সে বাড়ির মালিকের ছেলে অনিকের সারারাত পানি কালেক্ট করতে হয়েছে আমাদের ১৪ জনের খাওয়ার পানি যোগানোর জন্য। এই কষ্ট আর শ্রমের মূল্য টাকা দিয়ে নিরূপণ করা সম্ভব না। আমাদের থাকার জন্য ওরা কাঁথা, জায়গা ছেড়ে দেয় নিজেরা কষ্ট করে। দয়া করে ওদের সাথে দামাদামি করবেন না। আপনি কয়েকশো টাকা বেশি দিলে সেই টাকায় ওরা দালানকোঠা বানাবে না। শ পনেরো টাকা বেশি দিলেও আপনাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ১০০ টাকা করে হয়তো বেশি যাবে। বাট ওরা খুবই খুশি হবে।
৩. যারা ঘুরতে যাই, তারা চাকরিজীবী, না হলেও যারা স্টুডেন্ট তারাও মোটামুটি অবস্থা সম্পন্ন পরিবারের সন্তান। টাকা সবারই থাকে, বাট এসব হাই প্রোফাইল জায়গায় যাওয়ার সুযোগ সবারই হয় না। আয়োজক যারা, যাদের জন্য আপনার এসব হাই প্রোফাইল জায়গায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছে তাদের সম্মান দিন, মূল্যায়ন করুন।
৪. পাহাড়ে পানির কষ্ট, খাওয়ার কষ্ট যারা এইগুলো অভিযোগ করবেন, তারা এইসকল জায়গা থেকে ৩৯৭ কিলোমিটার দূরে থাকুন। পাহাড় কষ্টের জায়গা।
৫. পাইনক্ষ্যং পাড়া, রনিপাড়া, দেবাছড়া পাড়ায় মোটামুটি টিনের ঘেরাও দেয়া আর সিমেন্টের প্যান বসানো টয়লেটের ব্যাবস্থা আছে, অন্তত শূকর আপনার বিষ্ঠা নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়বে না।
৬. অনুমতি ছাড়া পাহাড়িদের ছবি তুলবেন না, আগে অনুমতি নিয়ে নিন।
৭. ইদানীং পাহাড়ী ছেলেপুলেরা পাংকু সেজে পাড়ায় ঘোরাফেরা করে। আপনারা পাড়ায় উঠেছেন শুনলে চাঁদাবাজি করবে তাদের জানান নি, তাদের সংঘ আছে ইত্যাদি বলে। এইসব ঝামেলা দূর করার জন্য রোয়াংছড়ি থেকেই শিক্ষিত ভাল গাইড নিয়ে নেন, গাইডই এই সমস্ত ব্যাপার ট্যাকল দেবে।
৮. প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখার অধিকার সবার। আমরা সুন্দর সুন্দর জায়গা দেখব, চোখ জুড়াব, সৌন্দর্য লুকিয়ে রাখার জিনিস না। তবে আমরা যেন প্রকৃতিকে নষ্ট না করি। আমাদের বাংলাদেশের গর্ব করার মত, দেখার মত জিনিস ঐ একটাই অবশিষ্ট আছে, বান্দরবান। আমাদের খামখেয়ালিপনার জন্য যেন একেও ধ্বংস না করে ফেলি। বিস্কিট, চানাচুর, শ্যাম্পুর প্যাকেট, সিগারেটের প্যাকেট ইত্যাদি যেন আমরা ফেলে না আসি। সাথে করে একটা পলিথিনের ব্যাগে ভরে সব ফেরত নিয়ে আসি।
৯. সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল - পাহাড় হচ্ছে পাহাড়। ইমোশনের জায়গা না। অনেকেই জেদ, আত্মমর্যাদার জন্য বলে থাকেন আমি যাবই, আমি পারবই। বাট জায়গামত গিয়ে কান্নাকাটি শুরু করবেন। তখন নিজেও বিপদে পড়বেন, গ্রুপমেটদেরও বিপদে ফেলবেন। বর্তমানে মেয়েরাও ট্রেকিং এ বেশ এগিয়ে। তবুও আমি বলব এক্সট্রিম লেভেলের জায়গাগুলোতে মেয়েদের না যাওয়াই বেটার। সবকিছু সবার জন্য নয়। সতর্কতার জন্য বলা, এক্সপেরিয়ান্সড মেয়েদের বেলায় আলাদা কথা।
১০. পাহাড়ে সোলারে মোবাইল চার্জ দেয়ার ব্যাবস্থা আছে, বাট সিম্ফনি, নোকিয়া সেটগুলো চার্জ দেওয়া যাবে। এন্ড্রয়েড সেটে সারাদিন ঢুকিয়ে রাখলেও চার্জ উঠেনা। তাই ১৬০০০ বা ২০০০০ mAh এর ২ টা (ন্যুনতম ১ টা) পাওয়ার ব্যাংক নিয়ে যাবেন বিশেষত যারা প্রচুর ছবি তুলবেন আর ভিডিও করবেন।
১১. হোটেল হিলভিউ সহ বান্দরবানের প্রায় হোটেলগুলোতে প্রতিটা খাওয়ার টেবিলে প্লাগ দেওয়া আছে, খাবার খাওয়ার সময় যেখানে বসে মোবাইলে চার্জ দিতে পারবেন
১২. রনিপাড়ায় রবি আর টেলিটকের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়, রোয়াংছড়িতেও, এই দুইটা বাদে অন্য কোন অপারেটরের নেট পাওয়া যায় না। তবে পাইক্ষ্যং পাড়ায় গ্রামীণের থ্রিজিতে আমি ফেইসবুক চালিয়েছি।
১৩. ব্যাক করার সময় যদি হেঁটে আসতে না চান, তাহলে যাওয়ার সময় যে গাড়িতে যাবেন, তার নাম্বার নিয়ে রাখুন, ব্যাক করার দিন ফোন করে দিলেই চলে আসবে। রনিপাড়া থেকে রোয়াংছড়ি চান্দেরগাড়ি পাবেন না।
অনেকেই অনুরোধ করেছেন আমাদের যাত্রার সবকিছু শেয়ার করার জন্য। তাদের সম্মানার্থেই ডক ফাইলটি লেখা হল। তবে আমরা যেন সবকিছুর মিস ইউজ না করি।
বিস্তারিত বর্ণনা, পিকচার, সেই ডেথজোনের ভিডিও, ঝর্ণার ভিডিওগুলো দেখতে নিচের লিংক গুলোতে যান। ভিডিওতে কিছুই দেখানো যায়নি আসলে কতটা ডেঞ্জারাস ছিল। দেখানো সম্ভবও না। এইগুলি অনুভবের জিনিস, জান হাতে নিয়ে নামাটাই ফরয ছিল, ভিডিও যেটুকু করা গেছে তাই যথেষ্ট। ভিডিও আর লিংকগুলো এখানে দেওয়ার উদ্দেশ্য হল যাতে সবাই স্পট আর বিপদের মাত্রা সম্পর্কে ক্লিয়ার কনসেপ্ট পান।


No comments:

Post a Comment